ছোট গল্প- অন্দরমহল | আব্দুছ ছালাম চৌধুরী
অন্দরমহল
আব্দুছ ছালাম চৌধুরী
এক দেশের এক রাজা ছিলো, তার রাজ্য ও ছিলো অনেক বড়। মোটামুটি ভালোই চলছে তার রাজত্ব----
একদিন রাজা অনেক'টা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তড়িঘড়ি করে রাণীকে বললেন,
যাও উজিরকে বলো হেকিমকে খবর দিতে-
রাজার আদেশ তাই রাণী দাসীকে বললেন, যাও, উজিরকে বলো হেকিম আনতে—
রাজা অসুস্থ,
যাও, রাজার নির্দেশ পৌঁছে দাও---
দাসী পায়ে পায়ে উজীরের দরবারে হাজির হয়ে রাণীর ফরমানের কথা জানিয়ে দিলো।
রাজার অসুস্থতার কথা শুনে উজিরের সারা শরীরে ঘাম ঝরতে থাকলো। তিনি ও তার সহকারী সেনাপ্রধানকে রাজার নির্দেশের কথা জানালেন।
বললেন--
তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করো;
রাজা রাণীর হুকুম বলে কথা,,,,
সেনাপ্রধান নিজেই দৌড়ে গেলেন হেকিমের কাছে। হেকিম রাজার অসুস্থতার খবর শুনে বউকে বললো,
------বউ, বউ,,, ও আমার লক্ষি বউ,, ওগো --- শুনছো?
মহারাজা খুব অসুস্থ, এক্ষুনি যেতে হবে।
এই আমি গেলাম,
এই আমি গেলাম বলে একবার সামনের দিকে যান, আর আরেকবার পিছনের দিকে তাকান।
ভয়ে হেকিমের ও হাত পা কাঁপতে লাগলো। মনে মনে বলছে,
হে মাবুদ-- তুমি আমাকে এবং রাজাকে রক্ষা করিও---
হে আল্লাহ,, কিছু করতে না পারলে আমার যে কি শাস্তি হবে তা আল্লাহ-ই ভালো জানেন।
হেকিম;
সেনাপ্রধান কে জিজ্ঞাসা করিলো,,
কি অসুখ হইছে?
সেনাপ্রধান বললো সে তো আমি জানি না।
এবার তো হেকিমের হাঁটু কাঁপছে। মনে মনে ভাবছে, যদি তেমন কিছু না করতে পারি তাহলে তো আমার গর্দান কেটে পাহাড়ের চূড়ায় লটকায়ে রাখবে। আল্লাহ জানেন আমার অপারগতা জন্য আমার স্ত্রীকে ও আবার কি শাস্তি দেয়।
ঠিক বের হবে, এমন সময় স্ত্রীকে ডেকে বললো;
শোনো বউ শোনো,
সন্ধ্যার আগে যদি আমি ফিরে না আসি তবে তুমি এই রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে চলে যেও।
--------বউ ঘাড় নেড়ে বললো আচ্ছা--
এবার ধীরে ধীরে হাকিম সাহেব উজিরের সাথে রাজার বাড়ি গেলেন।
রাজাকে ভালো করে দেখলেন।
হেকিম সাহেব তেমন কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। উপায় খুঁজতে অনেক্ক্ষণ দরবারের আশেপাশে হাঁটা চলা করতে লাগলেন। নিজের প্রাণের ভয়ে রাজাকে বললেন,,,,
হ্যেঁ হ্যেঁ হ্যেঁ হ্যেঁ,,,,
মহারাজ,,,, মহারাজ---আপনার শরীরের তেমন কিছু হয় নাই। অতিরিক্ত ভাবনার কারণে হয়তো মাথায় একটু গন্ডগোল দেখা দিছে।
---------সমস্যা নাই, সমস্যা নাই--
এই হেকিমের কাছে সকল রোগের ঔষধ আছে।
হ্যেঁ হ্যেঁ হ্যেঁ হ্যেঁ,,,,
এই নিন শত-সহস্র লতা পাতা দিয়ে তৈরী মহা ঔষধ। আমি ওষুধ দেবো আর কাজ হবে না সে কি হয়? হ্যেঁ হ্যেঁ হ্যেঁ হ্যেঁ,,,,
রাজা লতা পাতার কিছু রস-কস খেলেন। কিছুটা তেতা লাগছে বলে হাকিমকে একটা ধমক দিলেন। কী রে হেকিম, একটু মিঠা জাতীয় মেশানো যায় না --
তখনই রানী রাজাকে সামাল দিয়ে বললেন, একটু তিতা তো হবেই, দু-একটা দিন কিছু তো খেতে হবে, না খেলে কমবে কি করে।
একথা বলেই হেকিম যাইতে চাইছিলো, তখন রাজা জিজ্ঞেস করলেন, এই ওষুধটা কতবার খাইতে হইবে? এবং আর কি কি লাগবে তাহা একসাথে বলে যাও,,,
স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হেকিম আবার হেসে বললো---
আজ্ঞে হুজুর, আপনার মন ভালো রাখার জন্য প্রতিদিন উচ্চস্বরে হাসতে হবে।
আর কিছু না,,,
হ্যেঁ হ্যেঁ হ্যেঁ হ্যেঁ,,,, হ্যেঁ হ্যেঁ হ্যেঁ হ্যেঁ,,,,
তাছাড়া আমি তো সকাল বিকালে আসবোই।
এ কথা শুনে রাজা, উজিকে ডাকলেন, বললেন শুনেছো- হেকিম কি বললো? তা বসে আছো কেনো? যাও আমাকে হাসাতে পারে এমন লোককে হাজির হতে বলো।
যাও যাও।
রাজার কথার সাথে রাণী ও, উজিরের দিকে চোখ রাঙ্গায়ে তাকালেন —
উজির কার্নিশ করে দ্রুত রাজ-দরবার থেকে বের হয়েই বাকী সদস্যদের রাজার হাসির কথা জানিয়ে দিলো।
দ্রুত সমস্ত রাজ্যে এ খবর জানানো হলো,, বলা হলো যে রাজাকে হাসাতে পারবে, রাজা তাকে ১০০ স্বর্ণ মুদ্রা দান করবেন।
একশত স্বর্ণ মুদ্রার কথা শুনে তো সকলেরই, মাথায় হাত, একে অন্যের সাথে কথা বলছে আহারে আমি যদি রাজাকে হাসাতে পারতাম। এমনি তো মাঠে ঘাটে কত্তো হাসি তামাশা করি—
আহারে ---
কিন্তু রাজাকে হাসানো তো চাট্টি খানি কথা না। মনে মনে এক পা আগায় আর দুই পা পিছায়। আবার ১০০ স্বর্ণ মুদ্রার লোভ ও থেকেও নিজেদেরকে সরাতে পারছে না।
কৌতুহল বসতঃ অনেকেই জিজ্ঞেস করলো,
শোনো হে ঢোলক ভাই, এই যে খবরটা প্রচার করেছেন, সত্যি সত্যি কি রাজাকে হাসালে ১০০ স্বর্ণ মুদ্রা পাবো?
ঢোলক বললো,
আরে তোমরা কি পাগল? আমি তো বলছি না, রাজা বলছেন--- এটি রাজার কথা, রাজার নির্দেশ, উপস্থিত অনেকেই আবার জিজ্ঞেস করলো, যদি হাসতে না পারি তবে রাজা মারবেন --- মানে শাস্তি দেবেন?
ঢোলক বললো,,
সে তো রাজা বলেননি, তয়, যদি শাস্তির কথা জানতে পারি তবে আবারও জানাবো।
এবার--
ঢোলকের কথাতে সবাই ভয় পেলেও কয়েকজন মিলে চেষ্টা করতে উদ্ভুদ্ধ হলো।
যথারীতি একদিন রাজ দরবারে হাজির হলো। সকলেই কিছু না কিছু চেষ্টা করলো কিন্তু রাজা আর হাসলেন না। একদিন দুইদিন তিনদিন চারদিন পাঁচদিন এভাবে ১০-১৫ দিন গেলো। কেউ-ই রাজাকে হাসাতে পারলো না।
সকলের ব্যর্থতায় একদিন রাজা মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেন, আবার রানী কে নির্দেশ দিলেন, যাও উজির কে বলো, সেই হেকিমকে ধরে আনতে—
রাণী পুনরায় উজিরকে জানালেন, উজির আবার সেনাপ্রধানকে খবর দিলেন। এবার সেনাপ্রধান সৈন্য নিয়ে হেকিমের বাড়িতে হাজির হলেন।
ওদিকে,,,
সেনাপ্রধান কে দেখে একবার হেকিম পালাতে চাইছিলো, তবে চারিদিকে এত সৈন্য থাকায় সে আর পালাতে পারলো না।
প্রাণের ভয় থাকা সত্ত্বেও হেকিম রাজার বাড়ি যেতে প্রস্তুতি নিলো।
এমন সময় গৃহিনী আবার আসিয়া বললো, ওগো, আজ যদি তুমি সন্ধ্যার আগে ফিরে না আসো,,, তাহলে কি করবো?
হেকিম রাগে ক্ষোভে বললো, সে কি প্রত্যেকদিন বলা লাগবে, আগেই তো বলেছি সন্ধ্যার আগে বাড়ি না ফিরলে এই রাজ্য ছেড়ে চলে যেও।
একতা শুনে হেকিমের বউ হেকিমের উপর রাগ দেখালো— সুযোগ বুঝে দু'চার'টা কথা ও শুনিয়ে দিলো।
বললো,
হেকিম নাকি ছাই? ঘরে যেমন তোমার মুরদ নাই, তেমনি রাজার অসুস্থতা নিবারনের ও তোমার মুরদ নাই। হেকিমের সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে হেকিমের বউ হেকিমকে বললো, আমি যাবো রাজার বাড়ি।
প্রত্যেকবার এমন ভয় দেখিয়ে যাও, যে এমন ভয় নিয়ে আমি আর বাঁচতে চাই না।
হয় আমাকে সঙ্গে নিবা, নয়তো তুমি আজ আর যাইতে পারবা না।
বউয়ের জেদের কারণে হেকিম এবার হার মানলো। মনে মনে স্থির করলো, বউকে সঙ্গে নিয়েই যাবে। কিছুক্ষণ পরে রাজ দরবারে দুজনই হাজির হলো।
রাজা হাকিমকে দেখেই ধমকের সুরে বললেন, আরে কী একটা কথা বলে গেলে? এ রাজ্যের কেউ তো আমাকে আর হাসাতে পারলো না। তাই আমি নির্দেশ দিলাম এখন থেকে তুমি আমাকে হাসাবে -
নতুবা শাস্তির মুখোমুখি হতে প্রস্তুত হও,,,,
ভয়ে ভয়ে হেকিম অনেক চেষ্টা করলো, কিন্তু রাজাকে আর হাসাতে পারলো না। রাজার নির্দেশে এবার হেকিমকে কারাগারে প্রেরণ করতে নির্দেশ দেয়া হবে, এমন সময় হেকিমের বউ বিচলিত হলো।
বললো,,,
মহারাজ,,,, মহারাজ,,,
আমাকে একটা সুযোগ দেন,
রাজা বললেন কে তুমি?
তখন সেই মেয়েটি বললো, আমি আপনাদের হেকিমের বউ ---
রাজা বললেন,,,, ও! ----হেকিমের বউ!
বেশ, তুমি চেষ্টা করো- নতুবা তোমার স্বামীকে জেল কাটতে হবে।
এবার হেকিমের বউ বললো,, মহারাজা আমার কিছু শর্ত আছে ।
রাজা বললেন,
বলো- কি শর্ত?
আমি যখন আপনাকে হাসাবো তখন আপনার আশেপাশে কেউ থাকবে না, শুধু আপনি আর আমি থাকবো।
হেকিমের বউয়ের কথায় রাজা রাজি হয়ে গেলেন। সভা সমাপ্ত করে হেকিমের বউকে নিয়ে অন্দরমহলে গেলেন। সেইখানে হেকিমের বউ আর রাজা খুব হাসাহাসি করলেন। তাদের হাসাহাসির শব্দ অন্দরমহলের বাহির থেকেও শোনা যাচ্ছিলো।
শোনা যায় সেই হাসির কারণে না-কি মহারাজা শত বৎসর অব্দি জীবিত ছিলেন।
সমাপ্ত
Post a Comment